ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি

ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা সারা জীবনের জন্যে বয়ে বেড়াতে হয় এবং সারা বিশ্বে এর কারণে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

এছাড়া যে কোন ব্যক্তিই এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন।

শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে (গ্লুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়। এই জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হতে পারে।

এছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিডনি এবং অনেক সময় শরীরের নিম্নাঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে।

সারা বিশ্বেই এই সমস্যা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ৩০ বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা এখন চার গুণ বেশি- এই হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

চিকিৎকরা বলছেন, ডায়াবেটিসের এতো ঝুঁকি থাকার পরেও যতো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত তাদের অর্ধেকেরও বেশি এই রোগটি সম্পর্কে সচেতন নয়।

তবে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নীতি মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখানে তার কিছু উপায় তুলে ধরা হলো।

ডায়াবেটিস কেন হয়?

আমরা যখন কোন খাবার খাই তখন আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে (গ্লুকোজ) রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের যে হরমোন নিসৃত হয়, সেটা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয় চিনিকে গ্রহণ করার জন্যে। এই চিনি কাজ করে শরীরের জ্বালানী বা শক্তি হিসেবে।

শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এবং এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে।

কি কি ধরনের ডায়াবেটিস আছে?

ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের।

টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে।

বিজ্ঞানীরা এখনও বের করতে পারেন নি কী কারণে এরকমটা হয়। তবে তারা বিশ্বাস করেন যে এর পেছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে। অথবা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও এমন হতে পারে।

যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ১০ শতাংশ এই টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত।

অন্যটি টাইপ টু ডায়াবেটিস। এই ধরনের ডায়াবেটিসে যারা আক্রান্ত তাদের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না।

সাধারণত মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিশেষ কিছু এলাকার লোকেরাও এই ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া।

সন্তানসম্ভবা হলে পরেও অনেক নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। তাদের দেহ থেকে যখন নিজের এবং সন্তানের জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমানে তৈরি হতে না পারে, তখনই তাদের ডায়াবেটিস হতে পারে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে ৬ থেকে ১৬ শতাংশ গর্ভবতী নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়েট, শরীর চর্চ্চা অথবা ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের শরীরে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলে তাদের টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

ডায়াবেটিসের উপসর্গ কী

সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • খুব তৃষ্ণা পাওয়া
  • স্বাভাবিকের চাইতেও ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। বিশেষ করে রাতের বেলায়।
  • ক্লান্ত বোধ করা
  • কোন কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া
  • প্রদাহজনিত রোগে বারবার আক্রান্ত হওয়া
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
  • শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেটা শুকাতে দেরি হওয়া

চিকিৎসকরা বলছেন, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের লক্ষণ শৈশব থেকেই দেখা দিতে পারে এবং বয়স বাড়ার সাথে সেটা আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।

বয়স ৪০ বছরের বেশি হওয়ার পর থেকে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের মধ্যে এই ঝুঁকি তৈরি হয় তাদের ২৫ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই।

যাদের পিতামাতা, ভাই বোনের ডায়াবেটিস আছে, অথবা যাদের অতিরিক্ত ওজন, দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশের মানুষ, আফ্রো-ক্যারিবিয়ান অথবা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান তাদেরও এই ঝুঁকি বেশি থাকে।

ডায়াবেটিস কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?

ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।

সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।

রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মৃসন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।

এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।

আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।

স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।

এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।

শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রখা সম্ভব।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।

ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।

ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিসের কারণে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?

রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

শরীরে যদি রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হতে না পারে, যেসব জায়গায় রক্তের প্রয়োজন সেখানে যদি এই রক্ত পৌঁছাতে না পারে, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

এর ফলে মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে পায়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনে একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস।

কতো মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি।

১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দা*ড়িযেছে ৮ দশকি ৫ শতাংশ।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন বলছে, প্রাপ্ত বয়স্ক যেসব মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশের, যেখানে খুব দ্রুত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে।

সংস্থাটি বলছে, ২০১৬ সালে ডায়াবেটিসের কারণে প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

দু’ধরণের নয়, ডায়াবেটিস আসলে পাঁচ ধরণের: নতুন গবেষণার ফল

বিজ্ঞানীরা বলছেন ডায়াবেটিস আসলে পাঁচটি ভিন্ন ধরণের রোগ এবং এর প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে আলাদা চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে।

ডায়াবেটিস মূলত: ‘রক্তে অনিয়ন্ত্রিত সুগার লেভেল’ হিসেবে চিহ্নিত একটি রোগ এবং এখন পর্যন্ত সাধারণত একে দুটিভাগে ভাগ করা হয় – টাইপ ১ এবং টাইপ ২।

কিন্তু সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের গবেষকরা মনে করছেন, তাঁরা ডায়াবেটিস সম্পর্কিত আরও জটিল একটি চিত্র খুঁজে পেয়েছেন এবং এর ফলে এই রোগ নিরাময়ে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা চিকিৎসা দেয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গবেষণা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে, তবে চলমান চিকিৎসার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে হয়তো আরও সময় লাগবে।

বিশ্বে প্রতি ১১ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন – আর একবার আক্রান্ত হলে রোগীদের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, অন্ধত্ব, কিডনি অচল হয়ে পড়া এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার মতো ঝুঁকি বেড়ে যায়।

টাইপ ১ ডায়াবেটিস হলো মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কিত রোগ। এটি শরীরের ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা বা বেটা সেলকে আক্রমণ করে, ফলে রক্তে সুগার বা চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজনীয় এই হরমোনটির পর্যাপ্ত উৎপাদন হয়না।

অন্যদিকে, টাইপ ২-কে মনে করা হয় অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি রোগ হিসেবে, যেখানে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি ইনসুলিনের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে।

ডায়াবেটিস নিয়ে সর্বশেষ গবেষণাটি করেছে সুইডেনের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ডায়াবেটিস কেন্দ্র এবং ফিনল্যান্ডের ইন্সটিটিউট ফর মলিক্যুলার মেডিসিন। আর এতে ১৪,৭৭৫ রোগীর ওপর নজরদারী করা হয়, বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয় তাদের রক্তের।

গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে ল্যানসেট ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজিতে। এতে দেখানো হয়েছে যে ডায়াবেটিস রোগীদের পাঁচটি সুনির্দিষ্ট ক্লাস্টারে ভাগ করা যায়।

  • ক্লাস্টার ১ – এটা মোটা দাগে টাইপ ১ ধরণের তীব্র মাত্রার অটোইমিউন ডায়াবেটিস, যা মানুষকে তখনই আক্রান্ত করে যখন সে বয়সে তরুণ এবং তাকে দেখতে স্বাস্থ্যবান মনে হয়। এই ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না।
  • ক্লাস্টার ২ – এরা ওই ধরণের ইনসুলিন-ঘাটতির ডায়াবেটিস রোগী যাদেরকে শুরুতে ক্লাস্টার ১ এর রোগীদের মতোই মনে হয়। এরা তরুণ, এদের ওজন নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু ইনসুলিন উৎপাদনে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে – যদিও এদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোন গলদ নেই।
  • ক্লাস্টার ৩ – এরা তীব্র ইনসুলিন-প্রতিরোধী ডায়াবেটিস রোগী, যারা সাধারণত অতিরিক্ত মোটা। এরা শরীরে ইনসুলিন তৈরি করছে, কিন্তু এদের শরীর সেই ইনসুলিনে সাড়া দেয় না।
  • ক্লাস্টার ৪ – এটি ওজনের সঙ্গে সম্পর্কিত হালকা-ধরণের ডায়াবেটিস, যা অসম্ভব স্থূলকায় মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এ ধরণের মানুষ আবার মেটাবোলিজমের দিক থেকে ক্লাস্টার ৩ ধরনের মানুষদের চেয়ে বরং স্বাভাবিক মানুষদের কাছাকাছি।
  • ক্লাস্টার ৫ – বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত হালকা ধরণের ডায়াবেটিস, যা ওই ধরণের মানুষদের হয় যখন তাদের বয়স বেড়ে যায়। অর্থাৎ এই রোগীরা অন্য গ্রুপগুলোর মানুষদের তুলনায় বেশী বয়স্ক, তবে এদের ডায়াবেটিসের মাত্রা কম।

    গবেষকদলের অন্যতম, অধ্যাপক লিফ গ্রুপ বিবিসিকে বলেন, “এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা রোগীদের একেবারে যথাযথ ঔষধ দেয়ার ক্ষেত্রে এক কদম এগিয়ে যাচ্ছি।”

    তিনি বলেন, যে তিন ধরণের ডায়াবেটিস তীব্র মাত্রার, তার চিকিৎসা অন্য দুই ধরণের ডায়াবেটিসের চেয়ে জোরালোভাবে করা যেতে পারে। ক্লাস্টার ২ ধরণের রোগীদেরকে এখনকার টাইপ ২ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, কারণ তাদের অটোইমিউন রোগ নেই।

    গবেষণায় অবশ্য এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে এদের রোগের কারণ সম্ভবত তাদের বেটা-সেলের কোন খুঁত – এরা যে খুব মোটা সে কারণে নয়। আর তাদের চিকিৎসা ওই ধরণের রোগীদের মতো হওয়া দরকার যারা এখন টাইপ ১ হিসেবে চিহ্নিত।

    ক্লাস্টার ২ রোগীদের অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী, আর ক্লাস্টার ৩ রোগীদের বেশী ঝুঁকি কিডনি সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার – ফলে বেশী করে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কয়েকটি ক্লাস্টারের রোগীরা উপকৃত হতে পারেন।

    আরও ভালো শ্রেণীবিন্যাস

    লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের কন্সালট্যান্ট ও ক্লিনিক্যাল সায়েন্টিস্ট ড. ভিক্টোরিয়া সালেম বলেন, বেশীরভাগ বিশেষজ্ঞই জানতেন যে ডায়াবেটিসকে টাইপ ১ এবং টাইপ ২ – এই দু’ভাগে ভাগ করে যে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়, তা “খুব একটা সঠিক নয়”।

    তিনি বিবিসিকে বলেন, “কোন সন্দেহ নেই যে আমরা ডায়াবেটিসকে নিয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে চিন্তা করবো, তা এই গবেষণা সাহায্য করবে।”

    কিন্তু তিনি একই সঙ্গে সতর্ক করে দেন যে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে আজই কোন পরিবর্তন আসবে না।

    এই গবেষণা করা হয়েছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়। অন্যদিকে, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একেক রকম। যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় এই রোগের ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে বেশী।

    ড. সালেম বলেন, “এখনো অনেক কিছুই অজানা। এমনও হতে পারে যে জিন এবং স্থানীয় পরিবেশের কারণে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিসের ৫০০ ধরণের সাব-গ্রুপ রয়েছে।”

    “গবেষকদের বিশ্লেষণে পাঁচটি ক্লাস্টার পাওয়া গেছে, কিন্তু এই সংখ্যা বাড়তেও পারে,” বলছেন এই বিজ্ঞানী।

    ওয়রউইক মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক সুদেষ কুমার বলেন, “নিশ্চিতভাবে এটি কেবলই একটি প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের জানতে হবে এদের আলাদা আলাদা চিকিৎসা দিলে আমরা ভালো ফলাফল পাবো কি-না”।

    ডায়াবেটিস ইউকে’র ড. এমিলি বার্নস বলছেন রোগটি সম্পর্কে ঠিকঠাক মতো বুঝতে পারলে “তা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদাভাবে চিকিৎসা দেয়া এবং এটা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত জটিলতার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য” করতে পারে।

    তিনি আরও বলেন, “টাইপ ২ ধরণের ডায়াবেটিস আরও ভালো করে বুঝতে এই গবেষণা বেশ প্রতিশ্রুতির পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু এর মাধ্যমে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের কী উপকার হবে তা বোঝার আগে সাব-গ্রুপগুলো সম্পর্কে আমাদের আরও ভালোভাবে জানতে হবে”।

যে ১০টি লক্ষণ দেখলে ডায়াবেটিস রোগের পরীক্ষা করাতে হবে

ডায়াবেটিস হয়েছে, সেটা দীর্ঘদিন বুঝতেই পারেননি আফরোজা আক্তার। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই তিনি শুকিয়ে যাচ্ছিলেন, ক্লান্তি আর অবসাদ বোধ করছিলেন।

”অনেকদিন ধরে শরীরে খারাপ লাগছে দেখে একজন মেডিসিনের ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে ডায়াবেটিসের পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। সেখানেই ধরা পড়ে, আমার নাকি অনেকদিন ধরেই ডায়াবেটিস হয়ে গেছে।”

তিনি বলছিলেন, এরপর ডায়াবেটিস হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষার করিয়ে ওষুধ খাওয়া শুরু করেন।

তিনি একাই নন, ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক আক্রান্তদের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ টের পাননা যে তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ. কে. আজাদ খান বলেন, ”ডায়াবেটিস আছে এমন রোগীদের অন্তত ৫০ শতাংশ জানেন না যে, তার ডায়াবেটিস আছে। এ কারণে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সবার সচেতনতা বৃদ্ধি খুব জরুরি।”

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ।

বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে, তারা প্রথমদিকে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। কারণ এটা হচ্ছে ধীরগতির ঘাতক। যার হয়েছে, সেদিনই তাকে বিপদে ফেলবে না, কিন্তু আস্তে আস্তে তার শরীরের ক্ষয় করে দেবে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অশনাক্ত থাকলে বা চিকিৎসা না হলে কিডনি, লিভার, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে শরীরের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, চুল পড়ে যায়। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও ক্ষতির শিকার হতে পারে।

মি. সাইফুদ্দিন বলছেন, ”যারা যত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করবেন, প্রতিদিন যদি অন্তত ১০ হাজার কদম কেউ হাঁটেন, তাহলে ডায়াবেটিক হলেও সেটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। কিন্তু সেটা কতজন করেন?”

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ”কেউ ডায়াবেটিক হলে অবশ্যই তার জীবনযাপনে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।”